গল্প নাকি বাস্তবতা???

মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছেন বাবা। হয়তোবা ভাবছেন জীবনের সেইসব অলিগলির কথা যেগুলো তে পৌঁছে যাওয়ার কথা আমরা কখনো অবচেতন মনে অথবা ঘুমের ঘোরেও কল্পনা করিনা।বাবার ঘরের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আমি বাবা কে দেখছি।বাবার কাছে আমাদের ঘেঁষতে দেওয়া হয়না আজ তিন দিন।মা ই বাবার সব সেবা শুশ্রূষা করেন।
.
.
হঠাৎই সেদিন গোসলখানা থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে বাবা বললেন তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না! এতটুকু বলার শক্তিই বুঝি সঞ্চিত ছিলো।লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে আর আশ্চর্যজনক ভাবে ছটফট করতে লাগলেন।মা আমাদের খুব শক্ত করে জড়িয়ে রাখলেন, কাছে ঘেঁষতে দিলেন না।সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো! তবুও কি যেন বুঝে মায়ের হাত ছাড়িয়ে বাবার কাছে না গিয়ে বেরিয়ে গেলাম এক দৌঁড়ে।
আমাকে সাহায্য করুন! আমার আব্বা কে বাঁচান!
আকুল আবেদন, তবে মন গলেনি কারোই।
আমার করুণ আবদার কারো মন গলাতে যথেষ্ট ছিলো না বিধায় ফিরে এলাম।পরিচিত ডাক্তার কে ফোন করা হলো। মা বললেন,
জ্বর কাশি সঙ্গ দিয়েছে বেশ কদিন ধরে,ভয়ে ছিলাম খুব।আর কোনো আশা বেঁচে নেই।
ডাক্তার বললেন,
"হাসপাতালের পরিস্থিতি ভালো নয়। বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।হাসপাতালে যারা আছে তারা ডাক্তারের দেখা পায় সারাদিনে একবার। এছাড়া বাকি সব নিজেদেরই করতে হয় যাকে বলে সেল্ফ ট্রিটমেন্ট। যা বাড়িতে থেকেই করাটা সহজ বলে মনে করি।
pexels-public-domain-pictures-40975.jpg

.
.
সেল্ফ ট্রিটমেন্ট শব্দটার মানে বুঝলাম না আমি।তবে বাবা কে হাসপাতালে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলো। বাবাকে দেখে স্বাভাবিক মনে হলেও কোনো অংশে সুস্থ মনে হয়না।
আর তিনদিন বাদে ঈদ। ছোটবেলায় ঈদের আনন্দ বাদ সাধতো না।সামর্থ্য ছিলো কিনা জানা নেই তবে কোনো ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখেননি বাবা।১৫ রমজান থেকেই বাবা টুকটাক জিনিস কিনতে শুরু করতেন আমার আর আপার জন্য।তিন্নি ছিলো না তখন।বেতন পেলে আমার জন্য দুটো পাঞ্জাবি কেনা হতো। একটা লাল আরেকটা অন্য যেকোনো রঙ এর। নিজের জন্য কখনো কিছু কিনতেন না বাবা।সেই পুরনো পাঞ্জাবি দিয়েই চালিয়ে দিতেন।আপা ঢাকা মেডিকেলে পড়তো তখন।চলে আসতো ঈদের আটদিন আগে।কিন্তু ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম সে বিশাল ব্যাপার।অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে আসতে হতো তার। চাঁদরাতে আপার কাছে পাড়ার মেয়েরা মেহেদি দিতে আসতো।ছেলে হয়েও আমি ওদের সাথে বসে দুহাত ভরে মেহেদি দিতাম।মেয়েগুলো কুট কুট করে হাসতো।আপাও তাল মেলাতো ওদের সাথে।ঈদের দিন খুব ভোরে মা ডেকে দিতেন।গোসল সেরে বেরিয়ে এলেই পায়েসের সুমিষ্ট গন্ধ নাকে আসতো।পায়েস খেয়ে বাবার সাথে মসজিদে যেতাম। নামাজ শেষে বাবা আমাকে উচু করে ধরে সবার আগে আমার সাথে কোলাকুলি করতেন। সবার সাথে কোলাকুলি করতাম আমিও।সালাম করে আবার কচকচে নোট পেয়ে যেতাম কখনো। মায়ের কাছে জমা রাখতাম তবে ফেরত পেতাম খুব কম।কোলাকুলি শেষে কয়েকটা কাপ আইসক্রীম আর দুই লিটার এর একটা সেভেন আপের বোতল নিয়ে ফিরতাম বাপ বেটা।দুপুরে মা বিরিয়ানি রাধতেন। পেট পুরে বেশ মজা করে খেয়ে শেষে কোনোরকম স্বাদ হয়েছে বলে খেপিয়ে দিতাম মাকে। মা মুখ ফুলিয়ে বলতেন তোমরাই রেধো তবে! বাবুর্চি ভাড়া করো না হয়!
.
.
আপা মায়ের পক্ষ নিয়ে বলতো, এভাবেই জালাও আমার মাকে তোমরা আমি না থাকলে? আমি ব্যাঙ্গ করে বলতাম,
তুই থাকলেই বা কি?
আপা চটে গিয়ে বলতো,
হ্যাঁ তাইতো আমি কে!
তখন মা বাবা আপাকে জড়িয়ে ধরতেন! আমার হিংসে হতো খুব।আপা এলে মা বাবা আপাকেই বেশি আদর করতেন বলে।এবার আপা আসতে পারেনি।ঢাকায় শশুরবাড়িতে আছে।লক ডাউনের কারনে আসতে পারছে না।চেষ্টা করেছে খুব।
আপাকে নিয়ে খুব গর্ব হয়। নিজের আর নিজের আর নিজের পরিবারের কথা ভাবা ছেড়ে সেসব মানুষ গুলো কে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে।প্রতিদিন মার কাছে ফোন করে বাবার জন্য কান্নাকাটি করে।ডাক্তার হয়েও নিজের বাবার ব্যাপারে আপা একেবারেই দূর্বল! মূলত এই কারনে বাবার অবস্থার অবনতি হলেও পরামর্শের জন্য আপাকে ফোন না করে অন্য ডাক্তার কে ফোন করা হয়,পরিচিতই বটে।আপা বাবাকে এক নজর দেখার জন্য ছটফট করে। কিন্তু সাধ্য আর হয়ে ওঠে না।মা আঁচলে চোখ মুছে বলেন,
"মানুষের সেবা কর মা তাদের উসিলায় তোর বাবা কে আল্লাহ ভালো করে দেবেন"
আমি দৌড়ে এসে বলি, "আপা নিজের খেয়ালও রাখিস"
আপা ডুকরে কেঁদে উঠে তৎক্ষনাৎ ফোন রেখে দেয়।
.
pexels-tatiana-syrikova-3932772.jpg

.
এবারের ঈদে কারো জন্য জামা কাপড় কেনা হয়নি শুধু তিন্নির জন্য বাবা একটা লাল ফ্রক কিনেছিলেন! তিন্নি আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে সবথেকে ছোট। বয়স সবে পাঁচ। দিনের বেশিরভাগ সময় সে বাবার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বসে কাটায়।কি বোঝে কে জানে! হয়তো ছোট্ট মস্তিষ্কটাও উপলব্ধি করতে শিখে গেছে। লকডাউনের মাঝে বাবার অফিস ছুটি ছিলো মোট মিলিয়ে ১২ দিন। ২৫ তারিখ থেকে খোলা হয়েছে। পোশাক কারখানা টি আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে! বাসে চেপে যেতেন বাবা। মা রাজী ছিলেন না।কিন্তু বাবা ভোর হতে না হতেই ফজরের নামাজ আদায় করে ছুটে যেতেন।নাহলে সংসার চলবে কি করে? তাই কিছুই করার ছিল না। ইচ্ছে না থাকলেও বাবাকে বাসেই যেতে হতো। সব ঠিকই ছিল মাসখানিক। মাসের শেষ হয়ে এলো বাবা খুব কষ্টে মাস টা কাটিয়ে উঠতে পারলেন। মাসের প্রথম দিন ঈদ। সে জন্য মাসের ৩ দিন আগেই ঈদের বকসিস ও বেতন পাওয়ার কথা। বাবা বেতন নিতে গেলেন। সারাদিনের কাজের পর জানতে পারলেন এবার কোরনার জন্য বকশিস হবেনা। বাবা বেতন নিয়ে বাড়ি চলে আসলেন। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম বাবার মন খারাপ। খুব চিন্তার মধ্যে আছেন তিনি। মা বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন কি হলো আজ না তোমার বেতন পাওয়ার কথা। বাবা বল্লেন পেয়েছি তবে এবার নাকি ঈদ বকশিস হবে না। মা বল্লেন তাতে কি? এবার ঈদ পালন করতে হবে না। কারো অবস্থাই ভাল না। এবার বাদ দাও। ঈদের দিন এলো মা অন্য বারের মতো অতো আয়োজনকরে নি। তবে কিছু রান্না করা হয়েছে বুঝতে পারলাম। মা পায়েস রান্না করেছেন। সব বারের মতো না হলেও ঘরে বসে এবারের ঈদ টা কাটিয়ে দিলাম সবাই। সব ঠিকই চলছিলো কিন্তু রাতে বাবা হটাত কেমন করতে লাগলো। বাবা আবার ছটফট করতে লাগলো। মা বাবাকে ধরে বসে হাসপাতাল এ ফোন করলেন। তাদের সব খুলে বল্লেন।তারা জানালো এখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সব করনা রুগী দিলে ভরা। তাই বাবাকে ঢাকাই নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। রাতেই বাবাকে ঢাকাই নিয়ে আশা হলেও বাবা আর সইতে করতে পারেননি। সে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই চলে গেলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না তখনও। পরে মার কান্না দেখে বুজতে পারলাম বাবা আর নেই। বাবাকে কবর দেওয়া হলো আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে। বাবা আমাদের ছেরে চলে গেলেন কিন্তু তার অনেক আশা অসমাপ্ত রয়ে গেল।

সমাপ্ত

Pictures are taken from pexels.com



0
0
0.000
9 comments
avatar

Congratulations @troublemakerrr! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :

You received more than 200 upvotes. Your next target is to reach 300 upvotes.

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP

0
0
0.000
avatar
(Edited)

গল্প নাকি বাস্তবতা???

বাস্তবতা এইটা, এই করোনায় চিকিৎসা নে পেয়ে কতো পরিবার যে তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে হিসেব নেই।
আমি প্রসূতি মা নিয়ে স্বামিকে দেখেছি রাতের বেলা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াইতে কিন্তু কোথাও নিতেছিলো নাহ।

এরকম আরো কতশত ঘটনা রয়েছে,সরকারি হাসপাতালেও রোগী পরে আছে কিন্তু ডাক্তারের খবর নেই।

বাস্তবতা ভাই বাস্তবতা।

0
0
0.000
avatar

হুম ভাই বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের দেশের ও সমাজের এই রীতি নীতির পরিবর্তন আসবে কবে? কবে বাস্তব সমাজ দেখতে পাব? নাকি সাধারণত মানুষ এভাবেই জীবন যাপন করবে? সাধারণত মানুষ কি কখনোই সাধারণত জীবন যাপন করতে করতে পারবে না? নাকি এভাবেই সবসময় অবহেলিত জনগোষ্ঠীর নামে নাম লিখিয়ে জীবন টা কাটিয়ে দিতে হবে? আপনাকে অনেক অনেকে ধন্যবাদ সময় নিয়ে পুরো গল্পটা পড়ার জন্য ও আপনার মতামত প্রকাশ করার জন্য।

0
0
0.000
avatar

পরিবর্তন আসবে।দ্যয়ার ইজ এলওয়েজ এ হোপ।
আশা রাখতে পারি একদিন হয়তো চিএ টা বদলাবে। তারমধ্য কতটুকু ক্ষতি করে যাবে তার হিসেব নেই।

0
0
0.000
avatar

কষ্ট হলেও বলতে হচ্ছে এটাই এখন আমাদের দেশের বাস্তবতা।যেটা আমরা মানতে না চাইলেও মানতে হচ্ছে জানিনা কখনো এই দেশের রীতি নীতি পাল্টাবে কি না। কিন্তু আমাদের মত সাধারন মানুষদের এখন বেঁচে থাকাই মনে হয় অনেক কষ্ট।অনেক ভালো লাগলো পড়ে ধন্যবাদ এত সুন্দর কিছু আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।

0
0
0.000
avatar

আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। সময় নিয়ে পুরোটা পড়ার জন্য। আমার মতে দেশের এই রীতি নীতি পরিবর্তনের জন্য খুব তারাতাড়ি কিছু একটা করা খুব দরকার। হোক সেটা সরকার থেকে অথবা জনগণের পক্ষ থেকে।

0
0
0.000
avatar

বাস্তবতার সাথে মিলে গেছে। এই করোনায় কত পরিবার অসহায় হয়ে পরেছে তার কোন হিসেব নেই। আমরা এমন একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাস করছি যেখানে জনগণের কোন মূল্য নেই। সব ধরণের অযোগ্য লোক গুলো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে।

তবে আলো আসবেই।

0
0
0.000
avatar

সেই অপেক্ষাই আছি। ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য।

0
0
0.000