শেষদেখার সাধ | [ কল্পবাস্তব ছোটগল্প ]

avatar

মানুষ তার জীবনে স্বপ্নগুলোকে সাথে নিয়েই তো বেঁচে থাকতে চায়।শত বাধা বিপত্তি, জীবনের নানারকম অনিশ্চয়তা, ভর করে আসা দুর্যোগ অবহেলা, মাঝখানে যখন পালতোলা নৌকা বাতাসের লাগোয়া গতি থেমে যেতে চায়, মাঝি দাঁড় বেয়ে তীরে তরীটি ভিড়াতে উদ্যোগ নেয়। সময় তার নিয়মমতো সামনের দিকে এগিয়ে যায়, জীবনের ঘটনাগুলোও থেমে থাকে না, কোনো সময় মানুষ ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় - করতে হয়তো সক্ষম হয়, কিন্ত সবসময়ের জন্য তা হয়ে ওঠে না।

শূন্যতার অনুভূতিকে ঠিক কিভাবে সরল শুদ্ধ পথে প্রকাশ করা যায়? অনেকগুলো উপায় রয়েছে, বোধহয় মানুষ তার জীবনের বেশ অনেকটা লম্বা সময় এ অনুভূতিকে আলিঙ্গন করে। যখন দুঃখ আফসোসের চড়া স্রোত হৃদয়কে বেসামাল করে দেয়, তার মাঝে মাঝে কান্নার রংকে ছড়িয়ে দেয়া যায়, অন্য কেউ তা উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু শূন্যতা সে হৃদয়ে যতই গেঁথে থাকুক - মনের মধ্যস্থলে তার পৌষের শীতের মতো জেঁকে বসা ছাড়া নিস্তার নেই। দগ্ধ হওয়া হৃদয়ের শূন্যতা ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায়।

আজ একটি গল্প বলবো যেটির শিকড় সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে বিঁধে আছে। বাংলার আঙিনা, মাঠঘাট, রাস্তার দুই ধারের বাড়িঘর, কাঁচাপাকা দালানকোঠা, গ্রাম কিংবা শহরাঞ্চলের সংসার, যেখানেই তার বিস্তার হোক, ঘটনার পরম্পরায় যে একচ্ছত্র মিল তার রূপ সন্ধান করতে বেশি দূর যেতে হয় না,খুব বড় অন্তর্ভেদী দৃষ্টিও থাকতে হয় না।মানুষজন এ দেশে শহরবাসী, গ্রামবাসী বলে অলীক ভেদবিভাজন তৈরি করে রাখে, আদৌত তা অলীক। কারন, আমরা যে সে সবুজ শ্যামল প্রকৃতিঘেঁষা আম,জাম, বকুল,পেয়ারা,পাতিলেবুর ঘ্রাণে বেড়ে ওঠা বাঙালী, ইটপাথরের বাঁধাই, সে মাঠঘাটের আঁকাবাঁকা পথ ; মন কিন্তু একটাই - আবেগী, খেয়ালী,বাঙালী।

সাধ জেগেছিল রাতুলের আবার আরেকটিবার ১৫ নম্বরের বাড়িটির আঙিনায় গিয়ে একপলক দেখে আসা, সবকিছু কি ঠিক আগের মতোই আছে, না বছর চারেকের ব্যাবধানে বদলে গেছে। যেমনটি বদলে যাওয়ার খেলায় সবকিছু বেসামাল হয়, জীবনের সুন্দর ছিমছাম গোছানো দিনগুলো খেই হারায়, একটি দৃশ্যপট থেকে আরেকটিতে তরিয়ে যায়। মনের অবস্থাও সেই আগেরটির মতো থাকে না,পুরনো চরিত্ররা আর ফিরে আসে না - এ সবকিছু সে জানে। এক মুহূর্তের ভালোলাগা কখনো দীর্ঘদিনের মনস্তাপ বাড়িয়ে তোলে, এতটা যে রূপবদলের ভেলকির মাঝেও একটা পিছুটান থেকে যায়।

Source

পিছুটান ছিল বলে রাতুল ঘুরেফিরে সেই পুরনো পথের কিনারে এসে ভীড়তে চাইলো, যার পৃষ্ঠে চার বছর আগে নিত্যদিনের পদধূলা লাগতো। সে বারেবারে জামগাছটির নিচের সিঁড়িঘরের কিনারে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতে চাইতো জানালার ওপাশে সুকেশী কারো প্রতিচ্ছবি দেখা যায় কি না। সবসময় তার দরকার হতো না খুব একটা, কারণ সামনের দিকে প্রসারিত ছাদের ওপাশ ফিরে ছবি আঁকায় ব্যস্ত মেয়েটি তারার মতো সবটুকু ঔজ্জ্বল্য ধরে রেখেছে।

বাগানের হাসনাহেনার সৌরভে মুখরিত প্রতিটি কিনারা, রাতুল দেখতে পেত তার মতো করে যেন দীর্ঘ একটি একাকী জীবনের রেশ পেরিয়ে হঠাৎ ভালোলাগা ফিরে এসেছে, যখন মনে হতো হৃৎস্পন্দনও একটি অনিয়মিত ছন্দ, ছন্দহীন জীবনের পাঠ চুকিয়ে এবার ভালোলাগা ভাগ্যে জুটতে শুরু করেছে। হা হুতাশ জীবনে আসবে যাবে নিজের মতো করে কিন্তু হঠাৎ বিকেলে যদি সে সবকিছু ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন জোড়া লাগতে শুরু করে,যা কিছু বিসর্জনের ছিল তা পূর্ণতা পেতে শুরু করে তারপর নিজেকেই যেন গুছিয়ে নেয়ার শক্তি এক নিমেষেই চলে আসে।

অণিমা যেমন চুল বাঁধতে জানে তেমন ছবি আঁকতে জানে। লাল-নীল -কালো-হলুদের আঁকাবুকির টানে ফুটে উঠতে শুরু করে ক্যানভাসের চৌকাঠ, মনের কল্পনা আর সব ভাবনার বাস্তবরূপ উঠে আসে তার চিত্রকল্পে। সেই চিত্রকল্পে রাতুল নিজেকে দেখতে পায়, ভালোবাসার রেশ খুঁজে পায়, নতুন করে বিধ্বস্ত মনের জাহাজকে নতুন করে তৈরি করতে সাহস পায়, স্বপ্নগুলোকে নতুন সকালের প্রাণপ্রাচুর্যে বিনির্মাণ করতে শক্তি পায়। অণিমা তার কিছুই দেখতে পেত না, শুধু দেখতে পেত দূরের কেউ তার জন্য সমস্ত প্রহর ভেঙে, নিজের মূল্যবান সময় কাটিয়ে ক্যানভাসের ছবি দেখতে গিয়ে তার চোখের পলক ফেলা বুঝতে এসেছে।

ছোট সম্পর্ক স্বল্প সময়ের জন্য ছায়া ফেলতে পারে, যদি সম্পর্ক দৈর্ঘ্যে বড় হতে শুরু করে তাহলে তার পূর্ণতার একটি সম্ভাবনা থাকে। রাতুল তার স্বপ্নের দুর্বার টানে সামনে এগিয়ে যেতে চাইতো, মিশতে চাইতো মন পাবার আশায়, ছলচাতুরি আর নানা ফন্দিফিকিরে কাছে আসার চেষ্টা ডানা মেলে পথ চলতে শুরু করতো। অণিমা যে একটি জাগরুক টান অনুভব করতো না তা নয়, বরং তার অনেকখানি জগতজুড়ে রাতুল যে জায়গা করে নিয়েছিল তার উপস্থিতি সে ভেতর ভেতর বুঝতে পারতো, কিন্তু বাইরে কাউকে বুঝতে দিত না।


Source

অণিমার সে ১৫ নম্বরের বাড়ির ব্যালকনির রৌদ্রস্নাত বিকেলগুলো ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটার মতো নিমিষে উড়ে গেল যখন তার বাবার অন্য শহরে গত্যান্তর লেখা হয়ে গেল। রাতুল সে সময়টিতে একটি জরুরি কাজে অন্য শহরে ছিল, যে চিঠিপত্র আদানপ্রদান হতো তাতে অণিমা কখনে বলে নি যে এরকম কিছু হতে পার। তার স্বল্পভাষী রূপটিই কাল হয়ে দাঁড়ালো শেষমেশ। সেদিন খুব সকাল থেকেই ব্যাগপত্র, মালগাড়ি বোঝাই, আসবাব সরানো শুরু হলো, দুপুরের আগে শেষ সামগ্রীটিও চালান হলো বাড়িটি খালি করে দিয়ে, তারপর অণিমা তো গেলই, তার ক্যানভাসে আঁকা শেষ ছিন্নপত্র, রঙের গুঁড়ো দমকা হাওয়ায় উড়ে হারিয়ে গেল।

রাতুল ফিরে এসে দেখতে পেল স্বপ্ন হঠাৎ করে উড়ে চলে গেছে, আশেপাশে কেউ আর নেই। অণিমা এত বছরের অল্পস্বল্প কথায় এতটুকু তাকে বোঝাতে পেরেছিল যে, সে যদি কোনদিন চলেও যায়, তাহলে তার সাথে একদিন দেখা করার সুযোগ রেখে যাবে। হয়তো একটি চিঠির পাতায় লেখা মোবাইল নম্বর, কিংবা নতুন শহর বাড়ির ঠিকানা, বাবার কর্মস্থল, কোন ইঙ্গিত বা ধাঁধা, কিছু চিহ্ন অথবা প্রমাণ যার সূত্র ধরে সে এগিয়ে যাবে তাকে খোঁজার, তার স্বপ্নের পিছুপিছু, যাকে ঘিরে মনের নদী বয়ে যেত, কূলকূল ধারায়, বসন্তের হাওয়ায়, চক্ষু ছলছলে।

শেষবারের মতো এখনে রাতুলের সাধ জাগে, ১৫ নম্বরের বাড়িটির ধারে যেতে, হয়তো কোন চিঠি এখনো কোথাও অক্ষত আছে, তার স্বপ্ন আর অণিমার লুকোনো হাতছানিতে বেঁচে আছে। সে তা উদ্ধার করতে চায়, টানা দৌড়ে ছুটে গিয়ে তাকে বলতে চায়- এখনো ভালোবাসি তোমায়। তুমি কি আছ আগের মতো ?

[ গল্পটি সম্পূর্ণ আমার নিজের কল্পনাপ্রসূত, যা বাস্তবের কোন নির্দিষ্ট ঘটনা থেকে নেয়া হয় নি। তাই কোন চরিত্র, বাস্তব ঘটনা কিংবা কারো জীবনের সাথে আংশিক বা সম্পূর্ণ মিলে গেলে তা অনিচ্ছাকৃত ও অনভিপ্রেত। ]



0
0
0.000
0 comments