আজ মন চলেছে ছেলেবেলায়...
রাতের আকাশে তারার মেলা পুরো পূর্ণিমার চাঁদকে ছাপিয়ে ওঠে কখনো, চারপাশে হিজল গাছের পাতার মন ভোলানো সৌরভ আর ঝিঁঝিপোকার ডাক নিঝুম করে দিয়ে যায় যখন নীরবতার একটুখানি হিমেল হাওয়া রাতের সৌন্দর্যকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। যখন চাঁদ ঢলে পড়তে চায় তার আপন ঘরে, তারারা মিটিমিটি জ্বলতে থাকে, তার অপূর্ব আভা কখনো দেখেছেন কি? যে হালকা উদ্বিগ্নতার পাশ কাটিয়ে গাছগাছালি শেয়ালডাকা হাতছানি হরিনডাঙার মাঠকে মনের মন্দিরে নিয়ে আসে - তার পরিপূর্ণ আহবান সহজে মন ছাড়তে দেয় না।
Source
সে দিনও আর নেই, স্বপ্নরাঙা অনুভূতিগুলো মিইয়ে গেছে চারদেয়ালের বদ্ধ কুঠুরিতে,ইটপাথরের জাদুনগরটি খুব কায়দা করে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেছে কিছু চাওয়া পাওয়ার গন্ডির ঠিক মাঝখানে যেখান থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। অনুভূতি শুকিয়ে যেতে দেখেছি, যেমন করে অযতনে রাখা রজনীগন্ধার মৌ মৌ ঘ্রান হারিয়ে যায়, রংগুলো শুকিয়ে যায়, যন্ত্রমানবদের হিসাব নিকেশ, বেচাকেনার লেনদেন দিন প্রতিদিন এসে হাজির হয়, সকাল থেকে সন্ধ্যা, রাত্রিদুপুর শুধু কি আসলো, কি গেলো তার খাতাপত্তর মেলাতে ব্যাস্ত।
জীবন যখন অনেকদূর চলে যায়, যেমন একটি বৃক্ষ বড় হয় তার ডালপালা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, শেকড়গুলো মাটির বিস্তর গভীরে মিশে যেতে থাকে, তারপর কর্তব্যজালে প্রতিদিনের কাজকর্মের রাজা মন্ত্রীমশাইয়ের চাল ছক কষতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সেই গল্প বলা, রাজপুত্তুর, রূপকথার জাদুর কাঠি, রূপার কাঠির কাঠুরিয়ার রাজকন্যা, রূপনগরের রাজকন্যা,রাক্ষস খোক্ষসরা, মামদো -জটাধারী, পেটলো ভূতের দলের ঘুম পাড়ানি মাসিপিসির পিতামহ সুশীতল স্নেহের একমাত্র অকৃত্রিম পরশ যখন চলে যায় - তখন আর কেউ গল্প বলার থাকে না।
সারা বিকেল জুড়ে ছলছল চোখের চাওয়ায় কি এমন মায়া, মনের সবটুকু অভিমান,ক্লেশ আর দগ্ধ পরান স্মৃতিকাতরতায় ভেসে যায়, যখন ফের মনে পড়ে পুরনো কোন স্মৃতি, দিনের আলোর গভীরে ও পূরবী ডেকে গেলে, সেই দিগন্তরেখার কিনারে ঝরা পাতার মর্মরে সেই দিনগুলোতে তাঁর হাত ধরে সমস্ত দিনের শেষে নিরালায় কোন এক গাছের ছায়ায় বসে একটুখানি জিরিয়ে নেয়া, নদীর বয়ে যাওয়া পাড়ে শীফলতলার হাটে গরম গরম জিলিপিভাজা, মন্ডামিঠাই, গুড় সন্দেশ, তিনি যে বড্ড মিষ্টি খেতে পছন্দ করতো, যেমন করে পুরনো দিনের মানুষগুলোর দই, ঘি, মিষ্টান্ন ছাড়া খাবার জমতো না।
সেই যে কোন একদিন ভোরের বেলা যখন কাকের দল আর ঝু্ঁটিমোরগের ঘুম না ভাঙে, সে অরুন রাঙা প্রভাতবেলা রেলওয়ে প্লাটফর্মে দুটো প্রথম শ্রেনির টিকেট কেটে লালপাহাড়ির দেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া, কাউকে না জানিয়ে যখন ছোট্ট মনে স্বপ্নদেখার পালতোলা নৌকা হারিয়ে যাওয়ার ঢল খোঁজে, তারই রূপান্তরে পিতামহ ছেলেবেলার সাথীর মতো ঘুৃম ভাঙিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রার জন্য ঘুম থেকে উঠতে বলা, তারপর নদী, মাঠ, গহীন অরণ্যের সারি পিছনে ফেলে জেলেদের মাছ ধরা ছল,বানর, মোষ, নদীর কিনারা বেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যেন স্বর্গভ্রমনে বেরিয়ে পড়া।
যদি কেউ প্রশ্ন করে, ছেলেবেলায় ফিরে গেলে কোথায় যেতে চাইবেন - তাহলে বলবো সেই মুহূর্তে যখন মাথায় জীবনের পথের সূর্য প্রখর ছিল না, স্বপ্নগুলো বাঁধা ছিল না, মনের পুলকভাব সদা জাগ্রত, চিরন্তনী প্রভাতে যখন আমার দিগন্তরী হয়েছিল নিজের অন্তর্লীন জগতে, সুরন্জনা ছিল তার এলোকেশী চুলে আমার কাছে, সারা সকাল দুপুর একই সুরে বাজতো যে গান সারাবেলার ক্ষনে ক্ষনে, বসন্তের দিনে যায় যায় যখন পূর্ণতার ঘরে।
হৃদয়জুড়ে জানি সে দিন আর ছেলেবেলার পর যখন ছলছলে নয়ন শুকিয়ে গেল, তারপরে সুরন্জনা এসে প্রান জুড়িয়ে গেল। বছরের পর বছর কর্তব্যকাজে বাধা পড়া সময় আচ্ছন্ন করে হাতছানি দিয়ে ডাক পাঠাতে শুরু করলো। তারপরো, হারাতে দেই নি সেই অনুভূতিকে, বোধহয় সময় তার নিয়মমতো চলতে থাকে, মনের ভিতরকার সেই বহ্নিশিখার প্রদীপ নিজের মতো জ্বলে, কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না, হা হুতাশ ক্ষনিকের যদিও সে শিখা ধীরে ধীরে বয়ে চলতে চায় - তারপরো জীবনের স্রোত প্রবাহমান ধারা, আজীবন।
হয়তো একদিন আরো বয়স চুলে পাক ধরাবে, ইচ্ছেমতো হরিনডাঙার মাঠে ছুটে বেড়াতে পারবো না, সেই মন আর ইচ্ছে থাকবে না, যেমন করে জ্যোৎস্না রাতের ধারা গায়ে মাখানোর লোভে ঘুম কাটিয়ে ভয়কে ছাপিয়ে ছুটে যেতাম, তা আর হবে না। কিন্তু স্মৃতির আঙিনায় যদি কখনো মন কেঁদে ওঠে, তাহলে বেড়িয়ে আসবো সে দেশে - যেখানে মাঠের কিনারে শুনশান, হিমেল হাওয়া বইছে, সে কান্নারূপসী নদীটি বয়ে যাচ্ছে,তার শীতল জলে চাঁদের আলো চিকচিক, আহা, আর প্রাণের রূপ তার ভিতর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে, আমি সেখানে চিরদিনের, চিরকালের।
Congratulations @asif7! You have completed the following achievement on the Hive blockchain And have been rewarded with New badge(s)
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
Check out our last posts: