শ্রাবনের ধারা

avatar

গনগনে সূর্য মাথার ওপর আলো ঝরায় যার দীপ্তিতে সারা ধরনী জেগে ওঠে, অন্ধকারের জীর্ণতা স্থিরতা ভেঙে আপন আপন রঙে ভাসিয়ে তোলে সারা জগৎ সংসার। প্রকৃতির রূপবদল আর মানুষের মনের অন্তঃস্থিত শক্তি যেন মিলেমিশে একাকার, একটি থেকে অন্যটিকে সরিয়ে নেয়া যায় না। এ এক আত্নারূপ বন্ধন যা অনুভূতির প্রদীপকে ধরে রেখেছে ভাস্বর অলঙ্কারে, যার জন্য পৃথিবীর পথে পথে এত এত তত্ত্ব,সভ্যতার চিহ্ন, আদর্শ, নিজ নিজ পতাকার রং আর জীবনযাপনবর্ণালীর ছটা, মিলেমিশে একাকার।

ঝমঝম বৃষ্টি ঝরছে বিরামহীন, একটানা নিজ সুরে, আপন লয়ে ছন্দ নিয়ে সারা দিগন্ত ছুঁয়ে। মাঠঘাট ভেসে ভেসে জলের সমুদ্রনগরে পরিণত করে তুলেছে শহুরে কথকতার প্রানের নগরটাকে। নিত্যি বেচাকেনার পাঠ চুকিয়ে জীবনের টানে ব্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষগুলো অনিচ্ছাবশতই নিজেকে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে দিয়েছে, লাভের অঙ্কে ছোট্ট করে একটা লবডঙ্কা বসিয়ে। আজকাল মানুষগুলো নিজেদেরকে কাজে বসিয়ে নিজেদেরকেই ছুটি দেয় ইচ্ছেমতো, কিন্তু প্রকৃতিও বোধহয় মানুষকে অবসরে নিয়ে যেতে ভালোবাসে।

তার জন্য বিষম বারিশ ধারা শ্রাবনের জরাজীর্ণ মৌসুমকে রাঙিয়ে তুলেছে এক ধূসর ক্যানভাসের রঙে, মেঘের রং আর পেন্সিলের টানারেখা মিলেছে রঙের নগরে। হৃদয় জুড়ে শুধু এক অপরিমেয় ভালোলাগা, মন থেকে মনে ছুটে চলেছে দিকে দিকে, মাঠের পর মাঠ আর হরিণডাঙার প্রান্তরের তেপান্তরে যেখানে শব্দ আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনি করে মিলিয়ে দিয়েছে জীবনের সবটুকু আক্রোশ, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা আর দুঃখের সারি সারি রাশির হতাশাকে। বাদল ঘনিয়ে আসে, স্মৃতিরা বিস্মৃতিপ্রবন হতে শুরু করে, যেন যেতে দেয়া যাক যা নিরর্থক কালের কাছে।

মানুষের গল্পগুলো লেখা থাকে আপন রঙে, যেখানে হৃদয়ের পুষ্প সৌরভে ভরে ওঠে জীবনের কিছু জলস্রোত। শ্রাবনের ঢল কেন এতো সবিশেষ তার নজির ছড়িয়ে আছে সবখানে। যখন কান্নার রং ছাপিয়ে ওঠে বৈদগ্ধ্য উপাখ্যানকে পেছনে ফেলে, মর্মের ভেতরে বীণাসুরে বাজে কঙ্কন সুর, গানের ধুয়ার সারি সারি রাশি থেকে ভেসে ওঠে দুঃখবেদনার সারাৎসার, কিংবা যা দুঃখসাধনার তা চিরসুখের মহাগামী দিকে চলেছে। শ্রাবনের মেঘমালার বর্ষন নির্ঘাত উদাসী করে দেয়, কাছে থেকে দূরে, তারপর মাঠের শেষে।

অনেক প্রশ্ন এভাবেও উঁকি দিয়ে যায়, কেন মেঘের পরে বারিষ নামে আর দুঃখবিষাদ হর্ষযোগ একাকার হয়ে যায়? জীবনে সবটুকু সম্ভার পেয়েও মনের ভেতরে যাতনার অশ্রুবারি দেখা দিতে পারে আবার এই শ্রাবনের ধারাই সুখের সন্ধান দেয়, এক অদ্ভুত ভালোলাগার খেয়াল। যেভাবে সবাই নিজেদেরকে স্বপ্নের মাস্তুলে জড়িয়ে নেয়, তার ছায়ারাশি চারপাশে মিশতে থাকে। যা পেতে সচেষ্ট থাকা, তার কোন না কোন চিহ্নরূপ ছাপিয়ে চলেছে সবখানে।

জীবনের ছন্দ যদি কিছুকালের জন্য থেমে যেতে চায় তাহলে তাই হওয়া ভালো। কিছু সময় হওয়া উচিত ফুলের বাগানের চমৎকার দিক দর্শনের, কিছু সময় বৃষ্টির দিনের আত্নদর্শন, কারন এই তো সময় যখন নিজের সাথে প্রকৃতি মিশতে চায়, সেই পরদেশী প্রতিবেশীর মতো যে একবার এসে আবার হারিয়ে যায়। জীবনের লেনাদেনা আসবে আবার চলে যাবে, কিন্তু ক্ষনিকের কিছু পর্ব একটানা চিরদিনের যা থেমে থেমে বয়েই যাবে।

শ্রাবনকে প্রানের সাথে মিলিয়ে নেয়াটাই সার্থক, কারন এ ধরাতে তো বারিষধারা নেমেই প্রাণের কাছে প্রাণ যোগ করে। সজীব প্রকৃতি সবুজ রঙে রাঙা হয়ে ওঠে এই বাংলার কুঁড়েঘর থেকে দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য সত্যিই সুন্দর। মাঝে অনেককাল পার হয়ে ওঠে, জীবন একবাঁক থেকে অন্য বাঁকে ত্বরিয়ে চলে, মুহূর্তগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে নতুন দিনের সঞ্চার করে আর পথের কিনারে সূর্যের অস্ত যেতে চায়। সেই চিরচেনা মাঠঘাটের সুন্দর দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, গোধূলি, জলের ধারা, কি রূপ উন্মাতাল ঢেউ আর মনের সৃষ্টি ফোয়ারা পথ চলেছে, উদ্দেশ্যহীন।


Source



0
0
0.000
0 comments